পাঠপ্রতিক্রিয়া# সানাউল হক
মো. আ. কুদদূস পেশাগত জীবনে অনুজ সহকর্মী। বর্তমানে আমার জেলায় সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত। সততা এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য নিজ কাজে সুনাম কুড়াচ্ছেন তিনি। তারচেয়ে অধিকতর হলো, তিনি সাধারণের প্রিয় মানুষ। মানুষের প্রিয় হওয়ার কারণ শুধু সরকারি দায়িত্বে তাঁর নিষ্ঠা নয়—এ দায়িত্বের বাইরে তিনি অন্য একটি মহৎ কাজে স্বপ্রণোদিতভাবে যুক্ত। এ জেলার ঐতিহ্যের সূত্র ধরে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সাংগঠনিক দক্ষতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি অফিসসময়ের পরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সূত্রেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির মাধ্যমে তাঁর সাথে আমার পরিচয়।
স্থানীয় সাহিত্যআড্ডায় তাঁর আলোচনার আমি একজন মুগ্ধ শ্রোতা। লক্ষ করেছি, এমনকি সাহিত্যের বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল এবং আপডেটেড। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। দুবছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অদ্বৈত গ্রন্থমেলা এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্য পুরস্কার। এ বছর এ পুরস্কার লাভ করেন কবি ও অদ্বৈত গবেষক শান্তনু কায়সার (মরণোত্তর)। কথা ছিল এ বছর এসব কাজে আমি অন্যদের সাথে তাঁর সহযোগী হব। অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুই হয়ে উঠেনি। গত সপ্তাহে বাড়ি এসে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর দুটো বই আমাকে উপহার দেন। কবিতার বই কুপিবাতি এবং গল্পের বই অঙ্কুর।
অঙ্কুরে মো. আ. কুদদূস ১৪টি গল্প পরিবেশন করেছেন। ছোট ছোট গল্প। সরল বর্ণনায়। পরিচিত পরিবেশের পরিচিত চরিত্রের। তবে নিছক গল্প নয়। বরং এ গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে লেখক সচেতনভাবে কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন। প্রতিটি গল্পে এ সমাজের সমসাময়িক সুযোগ কিংবা সমস্যকে তিনি সামনে এনেছেন। আর এ সুযোগ কিংবা সমস্যার মধ্য দিয়ে গল্পের একেকটি চরিত্রকে প্রবাহিত করেছেন অতিরিক্ত ভণিতা ব্যতিরেকে। গল্পগুলো পড়ার সময় এটাই মনে হয়েছে। অর্থাৎ কিনা তিনি পাঠককে এ বিষয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন নির্দিষ্ট সামাজিক ফোকাসের আওতায়।
প্রথম গল্প সোনালতা। সোনা ও লতা দু গ্রামের দুজন অস্বচ্ছল প্রতীক মানুষ। যাঁরা পরোপকারী। সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে যাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমনকি নিজের প্রতিকূলতায় তাঁরা এ কাজে সম্পৃক্ত। গল্পের শেষাংশে এ দুজন মানুষের দেখা হওয়া এবং একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে লেখক ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন সমাজের ভালো কাজে ভালো মানুষগুলোর সম্মিলিত শক্তির প্রতি।
হিরেমোতিপান্না গল্পে অস্থির সমাজের ভঙ্গুর পারিবারিক বন্ধন এবং ফলশ্রুতিতে বহুবিবাহের প্রবণতাকে তুলে ধরতে গিয়ে এর কারণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
নির্জন ছাদের কার্নিশে শীর্ষক গল্পে উঠে এসেছে সমসাময়িক সমাজের শোঅফ ঝোঁক, ধর্মচর্চার পাশাপাশি অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়ার ভন্ডামি। আর গল্পের শেষটায় রয়েছে প্রবঞ্চিত হৃদয়ের নির্বিবাদ হাহাকার।
নতুন ট্রেন শিরোনামের গল্পে বন্ধুত্বের মাঝে অস্পষ্ট আচরণের ফলে ভঙ্গুর বিশ্বাস আর নিঃশব্দ আর্তনাদের কথা আনা হয়েছে।
অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমে বর্তমান সময়ের অস্থির লাইফস্টাইল, প্রবঞ্চনা, বহুবান্ধবের বাস্তবতা ইত্যাদিকে উপজীব্য করা হয়েছে ধূসর সন্ধ্যা শীর্ষক গল্পে।
কী এমন হয় গল্পে লেখক চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে এ সময়ে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে যেমন প্রচুর প্রস্তুতি, আয়োজন ও লোকসমাগম হয় তেমনি সমান্তরালভাবে কনসার্টের নাচগানেও হয়।
এসব উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে অঙ্কুর গল্পগ্রন্থে মো. আ. কুদদূস এ সময়ের একটি প্রতিবিম্ব তৈরি করতে চেয়েছেন নানান চরিত্রের অবতারণা করে নানান গল্পচ্ছলে।
তবে প্রিয় তমা গল্পের প্লট এ ধারার বাইরে। এখানে তিনি সমাজের নিষ্ঠুরতার বিপরীতে মানুষের প্রতি সাধারণ বেদে সম্প্রদায়ের মায়ামমতা, দরদকে গল্পাকারে সাজিয়েছেন।
পালকি প্রজেক্ট গল্পটি বাঙালির বাঙালিয়ানা আর চিরায়ত সংস্কৃতির লালন নিয়ে।
অন্যদিকে, এই মেঘ এই বৃষ্টি এ বইয়ের অন্যান্য গল্প রচনার স্টাইল থেকে একেবারে ভিন্ন। এ গল্পে দুজন মানুষের কথোপকথন এসেছে কবিতার ঢংএ। অর্থাৎ কাব্যের আদলে গল্পের পরিবেশনা। নিরীক্ষামূলক এ কাজটির সৃজনশীলতাকে স্বাগত জানাতে হয়।
অঙ্কুর গল্পগ্রন্থের প্রাকৃতিক সবুজ এবং রমণীয় মিষ্টি প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। বইটি প্রকাশ করেছে প্ল্যাটফরম। মূল্য ২২০ টাকা। রকমারিতে বইটি পাওয়া যাবে।
#বইমেলা২০২৪
#অঙ্কুর
#পাঠপ্রতিক্রিয়া
+ There are no comments
Add yours