ধারাবাহিত গল্প# নতুন ট্রেন# মোঃ আঃ কুদদূস
পূর্বাপর কিছু জানি না।
প্রজ্ঞা জানাল, আজকে সে ঢাকা যাচ্ছে। প্রমিত খানিকটা অবাকই হল। এখন ভরদুপুর। এই দুপুরে তার ঢাকা যাওয়ার কথা নয়। কারণ, ঢাকা যাওয়ার একটা প্লানপ্রোগ্রাম প্রজ্ঞার বরাবরই পূর্ব থেকেই থাকে। আজকে কেন হঠাৎ সে কোনো প্রকার প্রোগ্রাম ছাড়াই ঢাকা রওয়ানা দিয়ে দিল? ঘটনাটা একটু ভাবিয়ে তুলল প্রমিতকে। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই দুপুরে কেন সে ঢাকা যাবে? তার সাফসাফ জবাব, তাকে একুশে বই মেলায় যেতে হচ্ছে। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন সে যেতে বাধ্য। ইতোমধ্যে ট্রেনের টিকিট কনফার্ম করা হয়ে গেছে।
প্রজ্ঞা ঢাকা যাবে। প্রজ্ঞা বই মেলায় যাবে। প্রজ্ঞা ট্রেনে যাবে। প্রজ্ঞা আজকেই ফিরে আসবে। প্রজ্ঞা যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রজ্ঞার সাথে তার কয়েকজন সহকর্মীও যাবে। এতে প্রমিতের ভাবনার কি থাকতে পারে? এটা প্রমিতের জানারও বিষয় না। প্রমিতের জানা থাকারও কথা নয়। আর এসব নিয়ে প্রমিতেরও ভাবনার কিছু থাকতে পারে না।
প্রজ্ঞা ট্রেনে উঠে তার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে দেখল দিব্যি লোক বসে আছে। কামরা ভর্তি লোক। তিল ধারণের ঠাঁই নাই। কোনো রকম একটু দাঁড়ানোর জায়গা হলো। সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ভিড়ের মধ্যে তার মোবাইলটা খুলে যে প্রমিতকে জানাবে সে বসার আসন পায় নি, সেই সুযোগও তার হল না। অগত্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু তার বার বার মনে হতে থাকল বিষয়টা প্রমিতকে একটু বললে তার ভালো লাগত। তাই মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে হোয়াটসঅ্যাপে লিখল, ট্রেনে তাকে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে।
ঢাকা পৌঁছে প্রজ্ঞা জানাল, সে ঢাকা পৌঁছে গেছে। প্রমিত তাকে শুভকামনা জানাল। সন্ধ্যায় প্রজ্ঞা ফেইসবুকে বার্তা পাঠাল, প্রমিত কেন অভিমান করেছে? প্রমিত প্রজ্ঞাকে হ্যাঁ বা না কিছুই জবাব দিল না। প্রমিত সাধারণত কোনো বিষয় গভীরভাবে ভাবলে চুপচাপ বসে থাকে। আজকেও হয়তো তাই সে চুপচাপ রয়ে গেছে। এরপর সন্ধ্যায় প্রজ্ঞা হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠায়, সারাদিনে একটা খোঁজও নাও না। জবাবে প্রমিত শুধু লিখেছে, খোঁজ কেন টেনশনেই হয়তো দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হত, যদি তুমি একাকী ঢাকা যেতে। কিন্তু তোমার সাথে তো লোকজন আছে। এখন বার বার তোমাকে বার্তা পাঠালে তোমার অস্বস্তি লাগতে পারে। তাই চুপ করে আছি।
এরপর আর প্রজ্ঞার সাথে প্রমিতের কথা হয় নি। প্রমিত সারাক্ষণ রুমে, বারান্দায় ও ছাদে পায়চারি করে কাটিয়েছে। সন্ধ্যায় তার বাসার সামনের আমগাছের ঝুপড়িতে বসে প্রতিদিনের মতোই একটি কোকিল কুহু কুহু ডাক শুরু করেছে। এই মিষ্টি সুর প্রমিতের এই শীতোত্তর ফেব্রুয়ারিতে ভালো লাগলেও আজকে তার ভালো লাগে নি। তাই ইচ্ছে করে ঢিল মেরে কোকিলকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর ইচ্ছে করে ঘরে সাঁঝবাতি জ্বালায় নি। সারা শরীরে আঁধার মেখে শূন্যতার উপলব্ধি করতে চেয়েছে। এই সময় অনেক ফোন আসছে। সে ইচ্ছে করে অতীব জরুরি ব্যতীত অন্য কোন ফোন রিসিভ করে নি। অন্ধকারের ডেরায় সে একাকী চুপচাপ পড়ে ছিল।
রাত দশটায়ও প্রজ্ঞার কোনো খবর না পেয়ে সে মনে মনে দোয়া দুরুদ যা কিছু জানা ছিল সব পড়ে প্রার্থনা করেছে যাতে প্রজ্ঞা সুন্দরভাবে ফিরে আসতে পারে। এরপর সেই রাতে প্রজ্ঞা বারোটার দিকে জানায় সে বাসায় আসছে। অনেক অনেক কষ্ট হয়েছে। সারাদিনের নানা গল্প প্রমিতের সাথে শেয়ার করতে চায়। কিন্তু প্রমিত ঝরে পড়া অলকানন্দার মতো চুপচাপ পড়ে ছিল। প্রজ্ঞা কিছুক্ষণ বলার পর দেখলো সে একতরফা বলে যাচ্ছে। প্রমিত মাঝে মধ্যে হু হা করছে। প্রজ্ঞার এই রাতে গল্প বলাটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না৷ সে প্রমিতকে একটু হালকা করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে বরফ গলেছিল বলে মনে হয় না। প্রজ্ঞা বইমেলায় গেছে এটা নিয়ে প্রমিতের তেমন কোনো সমস্যা হয় নি। প্রমিতের গো ধরার মূল কারণ হলো দুটো। প্রথমত, প্রজ্ঞা প্রমিতকে বিষয়টা আগে বলে নি। আর প্রজ্ঞা তাকে বিষয়টা আগে না জানানোর কারণ ছিল, আগে জানালে প্রমিতও তার সাথে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করত। আর দ্বিতীয়ত, প্রমিতের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে যে, প্রজ্ঞা কিছু একটা গোপন করেছে। বিষয়টা প্রমিত কিছু একটা বুঝতে পারলেও সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করে নি। এই জিজ্ঞেস না করাটা ভদ্রতা। কিন্তু আজকাল যে, ভদ্রতা মানে দুর্বলতা — সেটা প্রমিতের অজানা।
প্রজ্ঞার সাথে প্রমিতের পরিচয় হওয়ার পর এমন ঘটনা ঘটেনি। পরিচয়ের শুরু থেকেই প্রজ্ঞার সম্পর্কে প্রমিত যতটুকু জেনেছে তাতে তার আপাতত কারো সাথে সম্পর্ক নাই। প্রজ্ঞা এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছে প্রমিতের সাথে। আজকাল মেয়েছেলেরা আগের মতো সম্পর্কের ক্ষেত্রে লুকোচুরি খেলে না। অভিভাবকরাও বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি টানাহেঁচড়া করেন না। কারণ, এখন সম্পর্ক মোটামুটি কমবেশি সবাই করে। ঐদিন শোনলাম, একজন রিকশাওয়ালা বলতেছিলেন, মামা, হুকটা টেনে দেই। পরিচিত কেউ দেখলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ছেলেটা একটু উঁচু কণ্ঠেই বলেছিল, ব্যাপার না। মামা চালিয়ে। প্রজ্ঞাও হয়তো তার সম্পর্কের কথা বলেছে। আর প্রমিতও সেসবে তেমন মাথা ঘামায় নি। কারণ, এখন এসব মুক্ত গোপন। সবাই জানে, কিন্তু কেউ বলে না।
প্রজ্ঞা তাহলে কি এমন গোপন করলো যার জন্য প্রমিত কষ্ট পাচ্ছে? সাতপাঁচ ভাবনা প্রমিতকে কিছুটা অন্যমনষ্ক করে রেখেছিল। তার দুটো ভাবনা চোখের সামনে সাপের মতো সাঁতরাচ্ছিল। একটি হচ্ছে, প্রজ্ঞা কি নতুন করে সম্পর্কে জড়ালো। আর সেটা যদি হয় তাহলে তো সেটা সবার আগে প্রমিতকে জানাবে। কারণ, প্রমিত প্রজ্ঞার বন্ধু, প্রেমিক নয়। প্রেমিকরা কখনোই তার প্রেমিকার নতুন প্রেমকে ভালো চোখে নেয় না। কিন্তু বন্ধু হলে নতুন প্রেমিকের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরে পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের খোঁজ খবর সংগ্রহ করে মেয়েটির কাছে পৌঁছায়। আগের দিনে পত্র পৌঁছিয়ে দিত। আর এখন নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়। আর অন্য ভাবনাটা হলো, প্রজ্ঞা হয়তো তার পুরাতন প্রেমিকের সাথে নতুনভাবে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সেটা হলেও তো সে প্রমিতকে বলতে পারে। কারণ, প্রমিত তো ভালো করেই জানে যে, প্রেম জিনিসটা বড়ো হারামি। একবার হয়ে গেলে তার আর হারায় না। আর সম্পর্ক একশ বার ভাঙলে একশ একবার জোড়া লাগে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। (অসমাপ্ত)
লেখক: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা।
কবি গীতিকার ও কথাশিল্পী।
কবি গীতিকার ও কথাশিল্পী।
+ There are no comments
Add yours